ডেস্ক রিপোর্ট : বৈষম্যহীন নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের বৈষম্যহীন দেশ গড়ার আহবান এবং জাতীয় ঐক্যের শ্লোগান জাতিকে ইতোমধ্যে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে।
সোমবার বিজয়ের ৫৩তম বার্ষিকী উদযাপন হয়ে ওঠে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাম্য ও সামাজিক মুল্যবোধের বাংলাদেশ গড়ার বিজয় দিবস।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে জাতি নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃপ্ত শপথে এবারের মহান বিজয় দিবস উদযাপন করেছে।
বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনার সরকার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে জন বিস্ফোরণের মধ্যদিয়ে উৎখাত হন। ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন, গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমন, গুম খুনসহ নির্যতনের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ও ক্ষুব্ধ জনতার রাজনৈতিক রোষানলের পড়ে তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতে পালিয়ে যান।
হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের নবযাত্রায় জাতি নতুন উদ্যম ও উদ্দীপনা নিয়ে এই প্রথম দিনটি পালন করেছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর অধিকাংশ দেশবাসী এ সময়টাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলেও অভিহিত করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রথম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আজ ভাষণ দিয়েছেন।
সকালে ঢাকা পুরাতন বিমান বন্দর এলাকায় (তেজগাঁও) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টের ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহিদদের প্রতি গান-স্যালুট প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম প্রহরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভে মোমবাতি প্রজ্বলন ও শহিদদের প্রতি দোয়া এবং মোনাজাতে অংশ নেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। রোববার দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিটে তারা মোমবাতি প্রজ্বালন করেন। এরপর তারা ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ ও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদদের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করেন। এ সময় জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, মুখপাত্র সামান্তা শারমীনসহ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আজ সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সকাল ৭টা ১২ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তার সঙ্গে পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তাও ছিলেন। এরপর জাতীয় স্মৃতিসৌধে সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশে অবস্থনরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দেশের জন্য আত্মদানকারী বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল নামে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আজ সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি বেতার/টিভি চ্যানেলে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল ইতিহাস ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় বার্তা সংস্থা-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গতকাল রাত থেকেই আলোকসজ্জা করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা করে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহে বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ঢাকাসহ দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিনেমা হলসমূহে বিনা টিকেটে ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহকৃত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং মিলনায়তনে ও উন্মুক্ত স্থানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
বিজয় দিবসটি উপলক্ষে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের সংগ্রামের ইতিহাস ও বিজয় স্মরণে র্যালি করেছেন ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ র্যালির আয়োজন করে। দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে বিজয় র্যালি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-শাহবাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার শহিদ মিনারে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে র্যালিটি শেষ হয়।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আসলেও সেই স্বাধীনতা ছিল অরক্ষিত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের বিজয় আমাদের স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
দেশবাসীকে মহান বিজয় দিবসের রক্তিম শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪-এর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে জনগণ প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ অনুভব করছে।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফ্যাসিজম ও আধিপত্যবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের পক্ষ থেকে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পনের মধ্যদিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেল ও খায়রুল কবির খোকন উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের অফিসারদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে এক সৌজন্য সাক্ষাৎ আখাউড়া-আগরতলা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আইএসপিআর জানায়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৮টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ স্মৃতিসৌধে শহিদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)।
দিবসটি উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সকালে বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল ৯টায় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএসএমএমইউ ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও বৃক্ষরোপণ, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বাদ জোহর দোয়া-মোনাজাতসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়াও জাতীয় এই দিবস উপলক্ষে আজ রোগীদের ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের মধ্যে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।